বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ এর বিস্তার বৈশ্বিক অর্থনীতির খোলনলচে পাল্টে দিচ্ছে। এই যেমন গত বছর চীন থেকে তাদের ৮৭টি কোম্পানি সরিয়ে নিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ সহায়তা ঘোষণা করেছে জাপান। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৩০টি যাবে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে। আর আসিয়ানের ব্যাপারে সামান্য খোঁজ খবর রাখা মানুষটিও বলতে পারবে, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান গন্তব্য হতে চলেছে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড। কিন্তু কেন? ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ প্রায় কাছাকাছি অর্থনীতির দুটি দেশ। অথচ বিগত কয়েক বছর থেকেই বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ভিয়েতনাম আমাদের ছাড়িয়ে যেতে শুরু করেছে। চীন ও জাপানের বৃহৎ তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম পছন্দের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে দেশটি। অথচ দেশগুলোর সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক থাকার পরও এই সময়ে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে তাদের বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। অন্য দেশগুলোর বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। আমাদের অন্যান্য খাতগুলোতেও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে একই রকম স্থবিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় হাইটেক পার্ক, ইকোনমিক জোনগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনার কথা বলতে শুনেছি আমরা। কিন্তু সেগুলো এখনো আলোর মুখ দেখেনি।

আশংকার বিষয় হলো, দেশের অর্থনীতিতে বিদেশি বিনিয়োগের এই যখন হাল, তখন আমাদের আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে করোনার প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়তে শুরু করেছে। গত এক বছরে লাখের ওপরে মানুষ কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছে। অর্থনীতি টালমাটাল থাকায় আন্তর্জাতিক এসব শ্রমবাজার দ্রুতই আবার ফিরে পাওয়া যাবে এমন সম্ভাবনা কম। আমাদের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্য। কিন্তু সৌদি আরবের মতো দেশ বর্তমানে বিদেশি শ্রমিক নির্ভরতা কমাতে শুরু করেছে। এই হাওয়া অন্যান্য দেশে লাগলে এই অঞ্চলের শ্রমবাজারের বিরাট একটি অংশ হারাবো আমরা। এমন দ্বিমুখী সংকটে রয়েছে আমাদের জনশক্তি রপ্তানি খাত। কিন্তু আমাদের অর্থনীতির প্রাণভোমরা তো এই বিদেশি শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স। তাই নতুন আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার সৃষ্টি করতে না পারলে গভীর সংকটেই পড়বে বাংলাদেশ।

অথচ সরকারি মহল কিছুটা তৎপর হলেই কিন্তু সংকুচিত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার সমস্যার সমাধান বের করে আনা সম্ভব। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের অজুহাত দেয়া হলেও এই সমস্যাগুলো সম্পর্কে আগাম ধারণা কিন্তু আরও বেশ কয়েক বছর আগ থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল। এই যেমন আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে কুয়েত, মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দরজা। অথচ এই বাজার গুলো ফিরে পেতে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরালো করেনি বাংলাদেশ সরকার। হ্যাঁ, সরকার বলতে পারে যে, অন্যান্য দেশের শ্রমবাজারে শক্তিশালী অবস্থান থাকায় তখন বিপদ খুব একটা বোঝা যায়নি। কিন্তু কূটনৈতিক মহলে দূরদর্শী চিন্তাভাবনার অভাব যে একটি দেশকে ভোগাতে পারে সেটি এখন হাতেনাতে টের পাওয়া যাচ্ছে।

আবার, আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে কাজের সন্ধানে যাওয়া আমাদের অধিকাংশ শ্রমিকই কিন্তু অদক্ষ। সরকার নিজ থেকে তাদের দক্ষ করার উদ্যোগ নেয় না। আবার এই শ্রমিকেরা যে নিজ উদ্যোগে দক্ষ হবেন এমন প্রতিষ্ঠান ও সুযোগও বাংলাদেশে সীমিত। ফলে বিদেশে গিয়ে তারা কিন্তু টেকসই কোন কাজে অংশ নিতে পারছেন না। তাই যেকোন অর্থনৈতিক মন্দার সময় তাদের ছেঁটে ফেলা সেই দেশগুলোর জন্য সহজ হয়ে গিয়েছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর শ্রমবাজারে দক্ষ কর্মী ছাড়া ঢোকাও সম্ভব নয়। তাই প্রতিবছর ব্যাপক চাহিদা থাকার পরও জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোতে কয়েক হাজারের বেশি বৈধ কর্মী পাঠাতে পারছে না বাংলাদেশ।

দক্ষ কর্মী সংকটের প্রভাব আমাদের দেশীয় শ্রমবাজারেও পড়ছে। বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ এখন আর কেবল সস্তা শ্রম দিয়ে সম্ভব হচ্ছে না। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনাগুলো এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে দক্ষ কর্মী সংকটের কারণে। আবার, বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত পরিবেশের অভাব, বৃহৎ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, কর্পোরেট করের উচ্চহার আমাদের দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা জোর গলায় বললেও, বিনিয়োগ সংক্রান্ত অধিকাংশ প্রক্রিয়া এখনো ডিজিটালাইজড করা সম্ভব হয়নি। ফলে আমাদের দেশের সম্ভাবনাময় বিনিয়োগগুলো চলে যাচ্ছে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের বাজারে।

এই সবকিছুর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে, দেশের মানুষের জীবনে। করোনাকালে দেশের আনুষ্ঠানিক খাতের ১৩ ভাগ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। বেতন কমেছে ২৫ শতাংশের। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্যমতে, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের পর দেশে প্রতি চারজন যুবকের একজন বেকার হয়ে পড়েছেন। ব্যাপকভাবে বেড়েছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। বিদেশ থেকে কাজ হারিয়ে ফেরা মানুষদের সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। তারা আবার কাজ নিয়ে বিদেশে যেতে পারবেন কিনা তা নিয়ে আছে সন্দেহ। দেশে-বিদেশে শ্রমবাজারের সংকট এই বেকার মানুষদের বিপদকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। কিন্তু সরকার নির্বিকার। তাদের উদ্যোগ যেন উন্নয়নের বুলির মধ্যেই আটকে আছে। হারানো আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার পুনরুদ্ধার, নতুন দেশে নতুন শ্রমবাজার তৈরি, দক্ষ শ্রমিকের যোগান, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান তৈরি- এমন জরুরি কাজগুলো তাদের কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। অথচ দেশের বেকার সমস্যা সমাধানে এই উদ্যোগগুলো খুবই জরুরি। আমাদের যত বেশি সম্ভব নতুন দেশে নতুন শ্রমবাজার তৈরি করতে হবে, দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করে শ্রমবাজারের পরিধি বাড়াতে হবে। কিন্তু কীভাবে সম্ভব হবে এগুলো?

প্রথমেই, আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের পরিধি বাড়াতে আমাদের সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। অভিবাসন বিষয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও এনজিওগুলো দীর্ঘদিন থেকেই শ্রমবাজার বিস্তৃত করার পরামর্শ দিয়ে আসছে। সরকার এতদিন এগুলো গুরুত্বের সাথে না নিলেও এখন থেকে নিতে হবে। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারকে কেবল মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে বেঁধে রাখলে হবে না। বরং ইউরোপের বিভিন্ন উন্নত দেশে কীভাবে আমাদের জনশক্তি রপ্তানি করা যায় সে বিষয়ে সরকারকে নজর দিতে হবে। জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা, ভিশন ছাড়া এটি সম্ভব নয়। আবার এসব দেশে জনশক্তি রপ্তানিতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বার্থসিদ্ধির ভাল সম্ভাবনা রয়েছে, এমন আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপরও জোর দিতে হবে। এছাড়া আফ্রিকার দেশগুলোতে জনশক্তি রপ্তানির বেশ ভাল সুযোগ রয়েছে। এনজিওগুলোও দীর্ঘদিন ধরেই আফ্রিকার কথা বলে আসছে। সরকারকে এখনই এই বিষয়ে উদ্যমী হতে হবে। নয়তো করোনা ভাইরাসের কারণে চীন, ভারত, ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোর চাপে থাকা অর্থনীতি চাঙা করার উদ্যোগে আফ্রিকার শ্রমবাজার হাতছাড়া হতে পারে বাংলাদেশের।  

দ্বিতীয়ত, উন্নত দেশগুলো সাধারণত দক্ষ কর্মী ছাড়া জনশক্তি রপ্তানি করতে চায় না। দেশের অভ্যন্তরেও আমাদের দক্ষ কর্মীর অভাব রয়েছে। এই দুই চাহিদা পূরণের জন্যই ব্যাপকহারে দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে সরকারকে। আমাদের যুব উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোকে সচল ও আধুনিকায়ন করে দেশ ও দেশের বাইরের কাজের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, দক্ষ জনশক্তির চাকরির বাজার অনেকটা টেকসই। তাই কোন বিপর্যয়ে অদক্ষ জনশক্তি নির্ভর অর্থনীতি যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দক্ষ জনশক্তির অর্থনীতি ততটা হয় না। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই দেশের তরুণ সমাজকে তথ্যপ্রযুক্তি ও কারিগরি খাতে দক্ষ করে তুলতে হবে এবং সেটিও যত দ্রুত সম্ভব।

তৃতীয়ত, দেশে বিদেশি বিনিয়োগ উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আমাদের দেশে বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, আইন-কানুনের মারপ্যাঁচে ব্যবসা শুরু করা বেশ সময়সাপেক্ষ। এগুলো বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে হতাশ করে। এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাজ সহজ করার জন্য এ সংক্রান্ত সকল কিছু ডিজিটালাইজড করারও প্রয়োজন রয়েছে। বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) দীর্ঘদিন ধরে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের কথা বলে আসছে। অথচ এটা এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। জনগণের টাকায় ইকোনমিক জোন, হাইটেক পার্ক তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সেখানেও বিনিয়োগ পরিবেশ এখনো তৈরি করতে পারেনি সরকার। এগুলো প্রতিদিনই বাংলাদেশকে পিছিয়ে দিচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, ভিয়েতনামের মতো আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো। কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমানে কাজ করা বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর লাভের অংক কিন্তু বেশ ভালো। তার মানে আমাদের ক্ষেত্র আছে, প্রয়োজন কেবল বিনিয়োগ উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা।

চতুর্থত, আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারেও বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। উদ্যোক্তা তৈরি করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য সহজে ব্যবসা বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য আইনী ও প্রক্রিয়াকরণ বাধা দূর করতে হবে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিসহ উদ্ভাবনী দক্ষতা কাজে লাগিয়ে প্রযুক্তিগত বাধা দূর করতে হবে। আমাদের দেশ উদ্ভাবনী ক্ষমতায় এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। ২০২০ সালের বৈশ্বিক উদ্ভাবনী সূচকে ১৩০টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ছিল ১১৬তম, যা খুবই হতাশার। এই অবস্থার উত্তরণ না ঘটলে আমাদের প্রযুক্তিখাতে সাফল্য দেখানোও কঠিন হবে। তবে উদ্ভাবনী দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব হলে একই সাথে অনেকগুলো বিষয়ে এগিয়ে যাব আমরা। আমাদের প্রযুক্তিখাত উন্নত হবে। ফলে আমাদের দক্ষ জনশক্তি তৈরি হবে, দেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের বিশাল সম্ভাবনা সূচিত হবে। সাথে সাথে দেশের শিক্ষিত তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হবে।

সবশেষে, আমাদের রপ্তানিমুখী বাণিজ্যকে বহুমুখী করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের রপ্তানি এবং এ সংক্রান্ত বিনিয়োগ কেবল আরএমজি খাত নির্ভর হয়ে পড়েছে। বহির্বিশ্বে এটি নেতিবাচক বার্তা দেয়। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসেও আমাদের দক্ষ শ্রমিক কেবল গার্মেন্টস খাতে, আমাদের রপ্তানি কেবল গার্মেন্টস নির্ভর। এগুলো রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের অদূরদর্শিতা এবং অদক্ষতার প্রমাণ দেয়। তাই এখন সময় এসেছে, আমাদের রপ্তানিমুখী বাণিজ্যকে বহুমুখী করার। আমাদের শিল্পখাতকে এক্ষেত্রে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। রপ্তানিমুখী শিল্পে যেমন শিল্পপতিদের আগ্রহী হতে হবে, তেমনি সরকারকেও প্রয়োজনীয় পরিবেশ এবং ভর্তুকি দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। যত দ্রুত আরএমজির পাশাপাশি নতুন আরেকটি বৃহৎ রপ্তানিখাত আমরা গড়ে তুলতে পারব, তখনই ঐ খাত সংক্রান্ত বিনিয়োগের পরিমাণও বাড়বে। আর এতেই সচল থাকবে দেশের অর্থনীতির চাকা, কর্মসংস্থান হবে আমাদের কয়েক কোটি বেকারের। তাই এই উদ্যোগগুলো সরকারের প্রয়োজনীয় মনোযোগ আকর্ষণ করুক এই কামনা।